বাংলাদেশ রেলওয়ে অনলাইনে এবং অফলাইনে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে।
টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ, বিনা টিকিটে ভ্রমণে জরিমানা করা এবং ভাড়া আদায় সহজ করার লক্ষ্যে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
টিকিট ব্যবস্থাকে আপগ্রেড করতে নতুন এই নিয়ম আগামী পয়লা মার্চ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশের রেলওয়েতে এখনও মান্ধাতার আমলের কাউন্টার-ভিত্তিক টিকেট কাটার ব্যবস্থা প্রচলিত।
সেখানে নতুন এই ব্যবস্থাকে বেশিরভাগ রেল ভ্রমণকারী স্বাগত জানালেও অনেক যাত্রীর কাছে নিয়মগুলো বেশ জটিল ঠেকছে, আবার কেউ কেউ এখনও বুঝতে পারছেন না নতুন সিস্টেম কীভাবে কাজ করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘জো বাইডেন’ ও ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প’সহ সুপরিচিত ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধন করে ভুয়া টিকিট কাটার অভিযোগ উঠেছিল।
টিকেট কাটার ক্ষেত্রে এখন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করা হলে এসব অনিয়মিত রোধ করা যাবে বলে প্রত্যাশা রেল কর্তৃপক্ষের।
পক্ষে বিপক্ষে মত
দেশটির একটি বড় জনগোষ্ঠী যেখানে প্রযুক্তির সুবিধার বাইরে, আবার অনেকের অনলাইনে বা অফলাইনে নিবন্ধন বা লগ ইন করার পারদর্শিতা নেই, তারা কীভাবে নিবন্ধন করবেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ঢাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত তাহেদা বেগম নতুন নিয়মের বিষয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি বছরে একাধিকবার ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনে ভ্রমণ করে থাকেন।
আগে কাউন্টারে গিয়েই টিকেট কিনতেন তিনি। এখন এনআইডি কার্ডে নিবন্ধনের প্রসঙ্গ আসতেই তিনি যেন ঘাবড়ে যাচ্ছেন।
“টিকেট বলে মুবাইলে করা লাগতো। আইডি তো আছে, কিন্তু আমার তো টাচ মুবাইল নাই, ইতা তো আমরা বুঝি না। স্টেশনে টাকা দিয়া টিকেট কিনলেই হয়। এতো ঝামেলার কি দরকার।” বলেন তিনি।
নতুন নিয়মের কারণে তার মতো অনেক যাত্রীর জন্য ট্রেনে ভ্রমণ করা জটিল হয়ে উঠতে পারে, সেক্ষেত্রে তাদের লাভের পরিবর্তে হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ নিয়ে তাহেদা বেগম বলেন, “যারা ব্ল্যাক (কালোবাজারি) করতেসে তাদেরে জেলে দিক। এই সিস্টেমে তো আমাদের সমস্যা। লেখাপড়া জানিনা। দুইটাই রাখুক, যারা বুঝে তারা মুবাইলে কাটবো, যারা না বুঝে তারা স্টেশনে যাবো।”
তবে কালোবাজারির দৌরাত্মে অতিষ্ঠ জোবায়েদ সানি এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করছেন। তিনি ঢাকা থেকে ভৈরব যাওয়া আসা করতে ট্রেন ব্যবহার করেন।
“নিয়ম তো ভালো, কিন্তু কতদিন ভালো থাকে, ওইটাই দেখার বিষয়। আমাদের তো ডিজিটাল সিস্টেম করে। পরে দেখা যায় সফটওয়্যার হ্যাং করে, এজন্য লাইনে দাঁড়াতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনলাইনে টাকা দিলাম, টাকা কাটল মেসেজ আসলো না, এজন্য দৌড়াও। তারপরও ডিজিটাল সিস্টেম ভালো, কিন্তু যদি এরকম ঘটনা ঘটে, সার্ভার স্লো হয়, কম্পিউটার কাজ না করে, তাহলে কিন্তু লাভ নাই। আবার ট্রেনের ভেতরের ম্যানেজমেন্টও থাকতে হবে।”
একই রুটে যাতায়াত করেন আয়শা আক্তার, তার চাওয়া একটাই যেন স্ট্যান্ডিং টিকেট এবং টিকেট ছাড়া যাত্রী ওঠানো বন্ধ করা হয়।
“আমি সবসময় টিকেট করি, কিন্তু কোনদিন বসতে পারি না। যারা টিকেট করে না তারা বসে থাকে। আমি একা কতো ঝগড়া করবো? ট্রেনের লোকরা এলে তাদের সিট থেকে উঠায় দেয়, অতোটুকুই। ট্রেনে ফেরিওয়ালা ওঠে, ফকির ওঠে, মালপত্র নিয়ে ওঠে। আবার নামার সময় ছাদ থেকে লোকজন মাথার ওপরে লাফ দেয়। এক কথায় মেয়েদের জন্য ট্রাভেল করা অসহ্যকর। সবার যদি টিকেট করা কনফার্ম করা যায় তাহলে এই ঝামেলাগুলো থাকবে না।” তিনি বলেন।
স্ট্যান্ডিং টিকেট প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আসছেন সাবেক রেল কর্মকর্তা মাহবুব কবীর মিলন।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এই নতুন নিয়মের পক্ষে বেশ প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আসছেন তিনি।
ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকেট প্রসঙ্গে তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “রেল আইন অনুযায়ী আন্তঃনগর বা নন-স্টপ ট্রেনে স্ট্যান্ডিং টিকিট দেয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৮৯০ সালের আইন অনুযায়ী যিনি স্ট্যান্ডিং টিকিট ইস্যু করবেন, তাঁকে জরিমানা গুনতে হবে। কাজেই সম্পূর্ণ অবৈধ একটি কাজের কোন অনলাইন ব্যবস্থা হয় না, বা হবে না। অবৈধ কাজের ভাড়া কমাবার কোন সুযোগ নেই।”
এরপরও এই অবৈধ কাজ একটি সরকারি সংস্থা কিভাবে করে আসছে, এমন প্রশ্ন রেখেছেন তিনি।
তার মতে, সম্ভবত বিনা টিকিটের যাত্রী বা অবৈধ যাত্রী নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রেলের নেই বিধায় এদের স্ট্যান্ডিং টিকিট ইস্যু করে রেলের রাজস্ব বাড়াবার একটি অঘোষিত উপায় বা পন্থা এটি।
তবে যাত্রীর চাপ যেহেতু বেশি, সেজন্য তিনি প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনে দুটি করে স্ট্যান্ডিং কোচ সংযুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি জানান “যেহেতু আমাদের নতুন নতুন কোচ সংগ্রহ করা হচ্ছে, কাজেই বিদেশ থেকে স্ট্যান্ডিং কোচ আনা যায়, অথবা আমাদের এখানেই তা’ কনভার্ট করার ক্ষমতা রয়েছে।”
টিকেট কাটায় কী পরিবর্তন আসবে
মার্চ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে টিকেটিং ব্যবস্থায় নতুন তিনটি সেবা অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
সেগুলো হল, জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের মাধ্যমে রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেটিং ব্যবস্থা, টিকিট চেকিং ব্যবস্থায় পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিন বসানো এবং অনলাইনের মাধ্যমে কেনা টিকিটের মূল্য অনলাইনে রিফান্ডের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ টিকিট ফেরত দিলে অনলাইনেই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।
রেল টিকেটের বিশৃঙ্খলা দূর করতে আগে থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল।
শুরুতে এনআইডি দেখিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনে প্রথম শ্রেণির টিকিট কেনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
কিন্তু ওই সময় সার্ভার জটিলতাসহ বেশি সময় লাগায় স্টেশনগুলোতে দীর্ঘ সারি তৈরি হয়ে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
চলতি বছরের শুরুতে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে সোনার বাংলা ট্রেনের ১৫% টিকিটে এই পদ্ধতি চালু করা হয়। তবে মার্চ থেকে শতভাগ টিকেট করার ক্ষেত্রেই নতুন নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
সেইসাথে ট্রেনে থাকা অবস্থায় যাত্রীদের টিকেট পিওএস মেশিনে চেক করার সিস্টেমও থাকবে। টিকিট জাল কী না তাও ধরা পড়বে পিওএস মেশিনে। প্রাথমিকভাবে ১০০টি পিওএস মেশিন দিয়ে কার্যক্রম শুরু করার কথা বলা হচ্ছে।
পরিচয় যাচাইয়ে যাত্রীদের এনআইডি, জন্ম-সনদের ফটোকপি বা ছবিযুক্ত আইডি কার্ড সাথে রাখতে বলা হয়েছে।
টিকেট চেক করার সময় যাত্রীর পরিচয়পত্রের সঙ্গে তার টিকিটে মুদ্রিত তথ্যের মিল না থাকলে বিনা টিকেটে ভ্রমণের দায়ে আইন অনুযায়ী জরিমানা করার কথাও বলা হয়েছে।
নতুন নিয়মে ট্রেনের টিকিটের রং পরিবর্তনসহ সেখানে যাত্রীর নাম, এনআইডি ও বয়সের তথ্য থাকবে। ফলে ওই ট্রেনে কারা যাতায়াত করেছেন তার পুরো ডাটাবেস রাখাও সম্ভব হবে।
পাশের দেশ ভারতেও যিনি ভ্রমণ করবেন তার নামেই টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। অন্য নামের টিকিট নিয়ে কেউ ভ্রমণ করতে গিয়ে ধরা পড়লে ওই যাত্রীকে আটক করা হয়।
মূলত যারা বিনা টিকেটে ভ্রমণ করছেন, সেটি রোধ করার জন্য এমন উদ্যোগ।